Saturday, December 23, 2017

আমরাও তবে ভালো নির্বাচন করতে পারি




রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে প্রথম আলো লিখেছিল, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে এই নির্বাচন ছোট হলেও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য বড় পরীক্ষা। বৃহস্পতিবার নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নির্দ্বিধায় বলা যায়, তারা পরীক্ষায় পাস করেছে। একটি সহযোগী দৈনিক শিরোনাম করেছে, ‘ইসি জিপিএ-৫ ’।

অনেক আগে থেকেই পাবলিক পরীক্ষায় নম্বর তুলে দিয়ে গ্রেডিং পদ্ধতিতে মান নির্ধারণ করা হচ্ছে। জিপিএ-৫ হলো সর্বোচ্চ মান। নির্বাচন কমিশন যদি রংপুরে একটি উঁচু মানের নির্বাচন করে থাকে, সেটি কেবল রংপুরবাসী নয়, সারা দেশের মানুষের জন্যই আনন্দ সংবাদ। এতে আবারও প্রমাণিত হলো অদৃশ্য শক্তির কারসাজি বা হস্তক্ষেপ না থাকলে আমাদের নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ভালো নির্বাচন করতে পারেন।
নির্বাচন কমিশনের দাবি অনুযায়ী, রংপুরে মডেল বা আদর্শ নির্বাচন হয়েছে কি না, সে নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এ জন্য নির্বাচন কমিশন ধন্যবাদ পেতে পারে। ধন্যবাদ পেতে পারেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাঁরা নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাঁরাও। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকেও ধন্যবাদ দেব। ফলাফল ঘোষণার পর তাদের কেউ সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির অভিযোগ এনে মানি না মানব না বলে রাজপথ গরম করেননি। যদিও ভোটপর্ব শেষ হওয়ার আগেই বিএনপি মনোনীত প্রার্থী কাওছার জামান ফলাফল নাকচ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি রংপুরের ভোটারদের অসম্মান করলেন। নির্বাচনে কারচুপি হলে তিনি অবশ্যই বলবেন; কিন্তু একটি ভালো নির্বাচনকে মন্দ বানানোর চেষ্টা খুবই গর্হিত কাজ।

কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে এতটাই ভঙ্গুর ও বিশৃঙ্খল করে গিয়েছিল যে তাকে শক্ত পায়ে দাঁড় করানোর কাজটি বেশ কঠিন। কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণ যে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল, সেটি পুনরুদ্ধার করা। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর যে পথনকশা ঘোষণা করেছে, সে অনুযায়ী চলতে পারলে আশা করতে পারি আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে, তা কেটে যাবে। ঘোষিত রোডম্যাপ বা পথনকশা অনুযায়ী কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছে। সবার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার কথা বলেছে। কিন্তু কাজী রকিব কমিশনকে বহুবার বলেও আমরা আলোচনায় বসাতে পারিনি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের ভূমিকা বিতর্কিত থেকেছে, যদিও সেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে বেশ কটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল। আলোচনা করলে যেমন অন্যের মত জানা যায়, নিজের কাজকে এগিয়ে নেওয়াও সহজ হয়। সেই আলোচনা কেবল নির্বাচন কেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়েই হওয়া উচিত। আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিকেরা এই সহজ কথাটি বুঝতে চান না। তাঁরা ভাবেন, আলোচনা করলেই বোধ হয় হেরে গেলেন।

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার ৯৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান। তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট। আর তাঁর নিকটতম আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বিদায়ী মেয়র সরফুদ্দীন আহমেদ পেয়েছেন ৬২ হাজার ৪০০। পাঁচ বছর আগের নির্বাচনে মোস্তাফিজার রহমান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট পেয়েছিলেন। আর সরফুদ্দীন পেয়েছিলেন ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট। এবার বিএনপির প্রার্থীর ভাগ্যে জুটেছে ৩৫ হাজার ১৩৬ ভোট। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর যোগফলও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর ভোটের চেয়ে অনেক কম।

গত পাঁচ বছরে জাতীয় রাজনীতিতে এমন কোনো ওলটপালট হয়নি যে ভোটের হিসাবে আকাশ-পাতাল ফারাক হতে পারে। তারপরও রংপুরের এই ফলাফল হওয়ার কারণ সম্ভবত ভোটাররা মার্কা দেখে ভোট দেননি, প্রার্থীর কাজের মূল্যায়ন করেছেন। গেলবার সরফুদ্দীন আহমেদ রংপুরবাসীকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার বেশির ভাগই পূরণ করেননি। বিশেষ করে বর্ধিত সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা থাকা সত্ত্বেও একটি পার্ক নির্মাণ ছাড়া পাঁচ বছরে কিছু করেননি তিনি। দ্বিতীয়ত, রংপুর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা প্রকট। সরফুদ্দীনের সঙ্গে অন্যান্য স্থানীয় নেতার ওঠাবসাই ছিল না। তিনি তাঁর মতো চলতেন। ফলে তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারেও তাঁরা নামেননি। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ফটোসেশনে যোগ দিয়েছেন মাত্র। অন্যদিকে বিগত নির্বাচনে হেরে গেলেও মোস্তাফিজার রহমান সুখে-দুঃখে নগরবাসীর পাশে থেকেছেন। তিনি জাতীয় পার্টির পাশাপাশি বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের সমর্থক এবং নির্দলীয় ভোটারদের ভোট পেয়েছেন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে জনপ্রিয়তা কারও একচেটিয়া সম্পত্তি নয় যে যুগ যুগ ধরে সেটি ধরে রাখা যাবে। জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হলে জনগণের জন্য কাজ করতে হবে।
সিটি নির্বাচনে মোস্তাফিজার কত ভোটে জিতেছেন, তার চেয়েও বিদায়ী মেয়র কত ভোটে হেরেছেন, সেই হিসাবটা নেওয়া দরকার। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রংপুরের নির্বাচনে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে দাবি করে বলেছেন, এটি বিএনপির জন্য একটি বার্তাও বটে। কেবল বিএনপি কেন, আওয়ামী লীগের জন্যও কঠিন বার্তা বলে আমরা মনে করি।
নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী জয়ী হলেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহ। কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কী ধরনের নির্বাচন করে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে যদি প্রার্থী জয়ী হন, তাহলে ভোটারদের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ থাকেন। আর একটি মন্দ বা বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো পদাধিকারী দায়িত্ব নিলে তাঁর প্রতি ভোটারদের যেমন অনাস্থা তৈরি হয়, তেমনি তিনিও ভোটারদের প্রতি কোনো দায়িত্ব বোধ করেন না। জনগণের জন্য কাজ না করে ভবিষ্যতে কীভাবে কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হওয়া যায়, সেই উপায় খুঁজতে থাকেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী প্রার্থীরা ভোটারদের ভয় করেন। এর অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। অনেক সময় ভালো নির্বাচন করেও ভোটাররা ভালো প্রতিনিধি পান না। আবার ভালো প্রতিনিধি পেলেও পরি

No comments:

Post a Comment

Wikipedia

Search results

Popular Posts